শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৪:৪৩ অপরাহ্ন
শিরোনামঃ
শিরোনামঃ
মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে লড়তে চান মরিয়ম বেগম ।। বুবুর চোখে জল।। বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ, প্রেমিক সেলিম কে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব ২০৪১ সালের আগেই পাবনা স্মার্ট জেলা হিসেবে স্বীকৃতি পাবে- রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার  ঈশ্বরদীতে মালবাহী দুইটি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ কুরিয়ার সার্ভিসে গাঁজা পরিবহনের সময় আটক-১ শ্যামলী বাসে আস্থা রেখে সর্বস্ব খোয়ালেন গরু ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ পণ্যের দাম, নামমাত্র বাজার মনিটরিং এর ফলাফল শূণ্য সিলেট সদর উপজেলার নির্বাচনে ‘মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান’ পদে প্রার্থী  কাকলী বঙ্গবন্ধুর  জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষে বিশেষ দোয়া ও ইফতার মহফিল অনুষ্ঠিত 

নজরুলের দ্রোহী সত্তা

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি / ৪৪৬ বার পঠিত
আপডেট : শনিবার, ২১ আগস্ট, ২০২১, ৮:৫৮ অপরাহ্ণ

নজরুলের দ্রোহী সত্তা

ভাস্কর সরকার

ভাস্কর সরকার

 

নিছক প্রতিবাদের জন্যই প্রতিবাদ নয়, শুধু বিদ্রোহের জন্যই দ্রোহ নয়, কার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, কিসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এসব কথা ভাবলে আদর্শের আদলটা ফুটে বেরুতে থাকে আমাদের নিজের মধ্যে৷ কিছু কিছু শব্দ আছে যাদের ভেতর লুক্কায়িত থাকে নানারকম সমস্যার জট খুলবার সূত্র৷ যখন বলা দ্রোহী, তখন একবচনে যিনি প্রতিবাদ করেন, যিনি বিদ্রোহ করেন, তিনি একজন ব্যক্তি কিন্তু তার প্রতিবাদ কিংবা বিদ্রোহ অনেককে জড়িয়ে ঘটে যায়৷ দ্রোহ হতে পারে কতকগুলো প্রচারের বিরুদ্ধে, সামাজিক রীতিনীতির বিরুদ্ধে, সংস্কারের বিরুদ্ধে, অনুশাসন-অপশাসনের বিরুদ্ধে, রাজনৈতিক দমন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে কিংবা সাম্প্রদায়িক ভেদ-বিভেদের বিরুদ্ধে ইত্যাদি৷ দ্রোহের প্রকাশ বেশিরভাগ সময় তাই ব্যক্তিগত বটে, আবার ব্যক্তিকে অতিক্রম করে গিয়ে সেই ছোঁয়া অনেক মানুষকে স্পর্শ করে তার সমকালকে, যুগকে, জীবন ও পরিবেশকে৷

কাজী নজরুল ইসলাম ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে দরিদ্র পরিবারে জন্মের পর দুঃখ-দারিদ্র্য ছিল তার নিত্যসঙ্গী। দুখু মিয়া ছিলো তার ডাকনাম। বাবার অকালমৃত্যুতে পরিবারের ভরণপোষণের জন্য তিনি শিশু বয়সেই মক্তবে শিক্ষকতা, হাজি পালোয়ানের মাজারে খাদেম, মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ করেন। তবে নিজের দুঃখ নিয়ে নয়, তিনি জাতির দুঃখ-ক্লেশ, দৈন্য-লজ্জা ঘোচানোর জন্য ভাবতেন সব সময়।
অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদে প্রবলভাবে আস্থাশীল এই মহৎ কবির আরাধ্য ছিল সত্য ও সুন্দর৷ প্রবল আত্মবিশ্বাসের সাথে তিনি বলেছেন, ‘সুন্দরের ধ্যান, তার স্তব গানই আমার উপাসনা, আমার ধর্ম৷ যে কূলে, যে সমাজে, যে ধর্মে, যে দেশেই জন্মগ্রহণ করি, সে আমার দৈব৷ আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই কবি৷'(প্রতিভাষণ: নজরুল ১৯২৯) ছোটবেলা থেকে জীবন সংগ্রামে অবতীর্ণ দুখুমিয়া একসময় হয়ে উঠেন বাংলার নবজাগরণের কবি৷

বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘বিদ্রোহী কবি’ খ্যাতি অর্জন করেছেন। তাকে বিদ্রোহী কবি বলা হয়- এটা সত্য কথা৷ তার অন্তরটা যে বিদ্রোহী, তা স্পষ্টতই বোঝা যায়৷ আমরা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে যাব-তখন সেখানে নজরুলের গান গাওয়া হবে৷ আমরা যখন কারাগারে যাব, তখনও তার গান গাইব৷১ সেটা যেমন বিদ্রোহী কবিতা রচনার জন্য তেমনি পরাধীনতা, সামাজিক রক্ষণশীলতা, গোঁড়ামি, সাম্প্রদায়িকতা, দারিদ্র্য ও অসাম্যের বিরুদ্ধে আপোষহীন লেখনি পরিচালনার জন্যেও। তিনি কেবল লেখনি পরিচালনা করেই ক্ষান্ত ছিলেন না, সক্রিয় ভাবে প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক, জাতীয়তাবাদী ও সংগ্রামশীল রাজনীতি, সংগঠন এবং সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন। যে সংগ্রামকে তিনি সাহিত্যে রূপায়িত করেছিলেন সে অভিজ্ঞতা কাল্পনিক বা তত্ত্বগত ছিলনা, তা তার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই উৎসারিত হয়েছিল আর সে কারনেই তার উদ্দীপনামূলক বিদ্রোহী কবিতাবলী বাংলার রাষ্ট্রীয় ও সমাজ জীবনে দীর্ঘকাল ধরে অভূতপূর্ব আলোড়ন জাগাতে সক্ষম হয়েছিলো।

১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের শেষদিকে নজরুল ইসলাম সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। সৈন্যদলে যোগ দেয়া নিয়ে তার মনোভাবকে অনেকটা অনুধাবন করা যায়৷ তিনি বিপ্লব এবং সংগ্রামকে কামনা করেছেন সর্ব-মূহুর্তে, কেননা তিনি ভেবেছেন যে সর্বপ্রকার অসদাচরণ এবং অকল্যাণ থেকে জাতি এবং দেশকে মুক্ত করবার একমাত্র উপায় হচ্ছে সংগ্রামকে অবলম্বন করা৷ এই বিদ্রোহ এবং বিপ্লবের আবেগ তার ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় প্রথম পূর্ণভাবে আত্মপ্রকাশ করে৷ ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় নজরুল ইসলাম সর্বাত্মক বিক্ষোভকে প্রশস্তি জানিয়েছেন এবং নতুন সৃষ্টির জন্য ধ্বংসকে অনিবার্য ভেবেছেন৷ এ-কবিতা দিয়েই নজরুল ইসলামের বাংলা কাব্যক্ষেত্রে আগমন, এ-কবিতাই তার স্থায়ী প্রতিষ্ঠার কারণ৷ বিদ্রোহী কবিতাতেই স্পষ্ট হয় যে নজরুল ইসলাম বেগবান এবং অস্থিরচিত্ত৷ জীবনের সর্ব প্রকার মোহনীয় আবেগকে তিনি অস্বীকার করতে চেয়েছেন, এবং গ্রহণ করতে চেয়েছেন একমাত্র অস্বস্তিকে৷

 

 

নজরুল বাংলাকে ভালোবাসতেন, ভালোবাসতেন বাঙালিকে। বাঙালির সুখের জন্য স্বাধীনতা- সার্বভৌমত্বকে অর্জন করার ও বিভূঁই থেকে আগত জোচ্চোরদের হাত হতে নিজ অধিকার আদায়ের কথা বলতেন উচ্চকিত কণ্ঠে। ভণ্ড, মুখোশ পরিহিত সমাজের তথাকথিত সমাজসেবকদের স্বরূপ করেছেন উন্মোচন। আর সেই কথাগুলো তিনি লিপিবদ্ধ করতেন মনের গভীর সাগরের তলদেশে ঝিনুকে সঞ্চিত মুক্তোদানার শব্দ সম্ভারের মাধ্যমে। যা হয়ে উঠতো নিপীড়িত মানুষদের কথা। যা গাত্রদাহ তৈরি করত মোড়লদের। সেসব সম্ভারের মধ্যে সব থেকে আবেদনমূলক সৃষ্টি হলো তার অনন্য কাব্যমালা। প্রখর এক সূর্য ছিলেন সামসময়িক বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর সেই প্রখর সূর্যের আলো থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে এক স্বতন্ত্র কাব্যধারা তৈরি করে নিজেকে অনন্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা কতখানি শক্তিমত্তার কাজ সমঝদার ব্যক্তির কাছে অনুমেয়। তার সেই অনন্য স্বতন্ত্রধারার দ্রোহী কাব্যগ্রন্থগুলির অন্যতম হলো- অগ্নিবীণা, সঞ্চিতা (কবিতা সংকলন), ফনী-মনসা, চক্রবাক, সাতভাই চম্পা, নির্ঝর, নতুন চাঁদ, মরুভাস্কর, সঞ্চয়ন, সাম্যবাদী, দোলন-চাঁপা, বিষের বাঁশি, ভাঙ্গার গান, ছায়ানট, চিত্তনামা, সাম্যবাদী ইত্যাদি।

আমাদের শিকল ভাঙার কবি, বিদ্রোহী কবি নজরুল তার চিন্তাভাবনায় ছিলেন অন্য সবার থেকে এগিয়ে। দেশের জমিন যখন বিদেশী বেনিয়াদের অত্যাচারে প্রলয়ের খণ্ডাংশ। তখন তিনি নির্ধারণ করে নিয়েছিলেন নিজস্ব কর্মপন্থা, সৃজনধারা। তিনি কায়মনোবাক্যে চাইতেন এই বেনিয়ারা হঠে যাক দেশ হতে। জনতা মুক্তি পাক কালো আইন ইত্যাদির কষাঘাত থেকে। নিজের দেশে আমরা নিজেই চাষবাস করে দু’মুঠো খেয়েপরে নিশ্বাস ফেলবো স্বস্তির। যখন অন্য কবিগণ ছিলেন পদ-পদবী, পদক, বিশেষ সুবিধা লাভের জন্য উন্মুখ। কাব্যের কোন শব্দ বিদ্রোহ করাতো দূরের কথা ঘৃণামিশ্রিত দৃষ্টিতে তাকায়নি ওদের(বৃটিশ) দিকে। সেখানে অদম্য এক প্রাণ ও সাহস নিয়ে হুংকার ছাড়লেন তিনি লোলুপ বৃটিশদের প্রতি। তিনি লিখেছেন,
মহা বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না—
বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত৷
আমি সেই দিন হব শান্ত৷

 

 

নজরুল ইসলাম সুনির্দিষ্ট কোনো ধর্ম, দর্শন কিংবা জীবন চর্যায় তিনি দীর্ঘকাল স্থির থাকতে পারেননি; তবুও সকল ধর্মের সার্বজনীন মূল্যের প্রতি ছিল তার প্রগাঢ় আস্থা৷ আর এই আস্থা তাকে হিন্দু কিংবা মুসলমানের কবি না করে, করেছে বাংলা ও বাঙালির কবি৷ তাই তো মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী সংগ্রামে এবং পরম সহিষ্ণুতা প্রতিষ্ঠা ও ধর্মীয় সম্প্রীতি সাধনায় তার বিদ্রোহী কবিতা বাঙালিকে যোগায় অনিঃশেষ প্রেরণা ৷ নজরুলের সাম্যবাদী ও অসাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে দ্রোহ প্রকাশ পেয়েছে তার রচিত নানা কাব্যে৷ ‘মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান’। মানুষ যদি অন্তরাত্মাকে না চেনে, অন্য ধর্মকে সম্মান করতে না শেখে, নিজেকে ‘সর্বশ্রেষ্ঠ’ প্রমাণের জন্য ব্যস্ত থাকে, তাহলে সমাজে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা গড়ে উঠবে না। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’। কিন্তু আজকের বাংলাদেশের বাস্তবতা উল্টো ‘সবার উপরে ধর্ম সত্য মানুষ সেখানে নাই’! নজরুল এসবের অবসান চেয়েছেন। গড়তে চেয়েছেন একটি সুন্দর অসাম্প্রদায়িক-সমাজ; শোষণমুক্ত বিশ্ব। নজরুল তার চারটি সন্তানের নাম রেখেছিলেন হিন্দু মুসলমানের মিলিত ঐতিহ্য ও পুরাণের আলোকে। তার সন্তানদের নাম যথাক্রমে কৃষ্ণ মুহাম্মদ, অরিন্দম খালেদ, কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধ। প্রথাগত গণ্ডির বাইরে এর চেয়ে অসাম্প্রদায়িক নিদর্শন আর কি হতে পারে!

‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত জালিয়াত খেলছো জুয়া’। মানুষের কল্যাণে ধর্ম সৃষ্টি। কিন্তু ধর্মকে ব্যবহার করে শোষণ-শাসন সৃষ্টি করা হয় বলে কবি নজরুল মনে করতেন। কার্ল মার্ক্সের ‘আফিম তত্ত্ব’র মতো নজরুল বললেন, ‘কাটায় উঠেছি ধর্ম-আফিম নেশা,/ধ্বংস করেছি ধর্ম-যাজকী পেশা,/ভাঙি ‘মন্দির’, ভাঙি মসজিদ,/ভাঙিয়া গীর্জা গাহি সঙ্গীত-/এক মানবের এক রক্ত মেশা’-(বিংশ শতাব্দী, প্রলয় শিখা)। যেন সত্যেন্দ্রনাথের ‘কালো আর ধলা বাহিরে কেবল, ভেতরে সবার সমান রাঙা’র মতো। আর একটা কবিতাংশের কথা উল্লেখ করাই যায়। ‘আশিটা বছর কেটে গেল, আমি ডাকিনি তোমায় কভু,/আমার ক্ষুধার অন্ন তা বলে বন্ধ করোনি প্রভু।/তব মসজিদ-মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবী,/মোল্লা পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবি।’ সাম্যবাদী কাব্যের ‘মানুষ’ কবিতায় স্রষ্টার প্রতি ‘ভুখা মুসাফির’র আত্মকথন। কবি নজরুলের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অত্র অঞ্চলের প্রধান দুটি ধর্মের অনাচার-অসাম্যের প্রতি সমান আঘাত হেনেছেন। মুসলমান ও হিন্দু ধর্মের তথাকথিতদের ওপর আক্রোশ ঝরে পড়েছে কবিতার পরতে পরতে। তার কবিতায় ‘মানুষ’ই মূখ্য উপজীব্য। অসাম্প্রদায়িক এমন সাহিত্যিক বিশ্বে বিরল বটে।
বন্ধু, যা-খুশি হও,
পেটে পিঠে কাঁধে মগজে যা-খুশি পুঁথি ও কেতাব বও,
কোরান-পুরাণ-বেদ-বেদান্ত-বাইবেল-ত্রিপিটক-
জেন্দাবেস্তা-গ্রন্থসাহেব প’ড়ে যাও, যত সখ-
কিন্তু, কেন এ পন্ডশ্রম, মগজে হানিছ শূল?
দোকানে কেন এ দর কষাকষি? -পথে ফুটে তাজা ফুল!
তোমাতে রয়েছে সকল কেতাব সকল কালের জ্ঞান,
সকল শাস্র খুঁজে পাবে সখা, খুলে দেখ নিজ প্রাণ!
তোমাতে রয়েছে সকল ধর্ম, সকল যুগাবতার,
তোমার হৃষয় বিশ্ব-দেউল সকল দেবতার।
কেন খুঁজে ফের’ দেবতা ঠাকুর মৃত পুঁথি -কঙ্কালে?
হাসিছেন তিনি অমৃত-হিয়ার নিভৃত অন্তরালে!

 

 

হিন্দু ধর্মালম্বীদের সতীদাহ প্রথা, বিধবা বিবাহ প্রথা রদের পরেও তৎকালীন হিন্দু-মুসলিম উভয় সমাজে নারী ও পুরুষের যে বৈষম্য বিদ্যমান সে ক্ষেত্রেও নজরুলের ছিলো প্রতিবাদী অবস্থান৷ পুরুষ শাসিত সমাজে নারী লাঞ্ছিত, অপমানিত, অবহেলিত ও অস্বীকৃত৷ অথচ সমাজে ও সভ্যতায় নারীর অবদান পুরুষের চেয়ে কোন অংশে কম নয়৷ নজরুলের দৃষ্টিতে নারীর কল্যাণী ও মাতৃরূপ বিশেষভাবে প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠেছে৷ ব্যক্তি জীবনে তিনি মাতৃসমা বিরজাসুন্দরী দেবী ও মিসেস এম. রহমানের অকৃপণ স্নেহলাভ এবং এ দু’জনের মধ্যে মাতৃরূপ অবলোকন করেছেন৷ এর ফলে নারীর মাতৃরূপ তার নিকট উজ্জ্বলরূপে প্রতিভাত হয়েছে এবং বারাঙ্গনার মধ্যেও তিনি মাতৃরূপের পরিচয় পেয়েছেন৷

কে তোমায় বলে বারাঙ্গনা মা, কে দেয় থুথু ও গায়ে?
হয়তো তোমায় স্তন্য দিয়াছে সীতা সম সতী মায়ে৷
না ই হ’লে সতী, তবু তো তোমরা মাতা ভগিনীরই জাতি,
তোমাদের ছেলে আমাদেরই মত, তারা আমাদের জ্ঞাতি৷

 

 

নারীর প্রতি সকল অবিচার ও অত্যাচার উচ্ছেদ সাধনে তিনি দ্রোহ ঘোষণা করেছেন৷ সঞ্চিতা কাব্যে বারাঙ্গনা কবিতায় তিনি বাংলার সমাজের চোখে আঙ্গুল দিয়ে বলেছেন, অসতী মাতার পুত্র যদি জারজ হয় তাহলে অসৎ পিতার পুত্রও নিশ্চয় জারজ৷ তিনি সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে পুরুষ ও নারীর সমানাধিকার এবং সমমর্যাদা দাবী করেছেন৷

যুগে যুগে কালে কালে অত্যাচারীদের খড়গের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল কবিদের মসি। যেখানে তাদের থামাতে পারেনি শোষকের তীক্ষ্ণ অসি। সেরূপ আধুনিক বাংলাসাহিত্যের প্রথম বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম৷ তিনি বিদ্রোহী, তার বিদ্রোহ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে। কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে। ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে। ভণ্ডামির বিরুদ্ধে। শঠতার বিরুদ্ধে। দ্রোহ জাগাতেন গরীবের হৃদে। শ্রমজীবী মানুষদের মর্মযন্ত্রণা ধারণ করে রচেছেন কাব্যমালা৷ উন্নত শিরে অসহায়, নিঃস্বদের দুঃখব্যক্ত করেছেন শব্দের বুননে। পরিশেষে তার বিদ্রোহী কবিতার সুরে বলতে হয়,
আমি চির-বিদ্রোহী বীর—
আমি বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির উন্নত-শির!

 

 

তথ্যপঞ্জি:
১. অঞ্জলি লহ মোর, ষান্মাসিক সাহিত্যপত্র, ডিসেম্বর-২০০০, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, নওগাঁ, পৃষ্ঠা-১৩৷
২. বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত (আধুনিক যুগ), মুহম্মদ আব্দুল হাই ও সৈয়দ আলী আহসান, ফেব্রুয়ারি-১৯৯৭, আহমদ পাবলিশিং হাউজ, ঢাকা, পৃষ্ঠা-৩০৬৷
৩. অগ্নিবীণা, কাজী নজরুল ইসলাম, জানুয়ারি-২০০০, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, পৃষ্ঠা-১৭৷
৪. সঞ্চিতা, কাজী নজরুল ইসলাম, জানুয়ারি-২০১৩, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা৷
৫. নজরুল প্রতিভা, মোবাশ্বের আলী, ডিসেম্বর-১৯৯৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ,ঢাকা, পৃষ্ঠা- ১১১৷
.
ভাস্কর সরকার
পিএইচ.ডি গবেষক ও প্রাবন্ধিক
ফোকলোর বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরও খবর

ফেসবুকে আমরা

এক ক্লিকে বিভাগের খবর
Bengali Bengali English English Russian Russian
error: Content is protected !!
Bengali Bengali English English Russian Russian
error: Content is protected !!