ভারতের মেঘালয় ও আসাম রাজ্য এবং বাংলাদেশের সিলেটের অঞ্চলে পাহাড়-টিলার বুকে পানগাছের পরতে পরতে যে নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর জীবনগাথা ছড়িয়ে আছে তারা হলো ‘খাসিয়া’ সম্প্রদায়। বসবাসকারী মোঙ্গলীয় মহাজাতির একটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ওরা। আদি মঙ্গোলয়েড জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত এদের গায়ের রঙ চাপা তাম্রবর্ণের হয়। পুরুষের হালকা দাড়িগোঁফ প্রায়ই দেখা যায়। পুরুষের তুলনায় মেয়েরা বেশ সুঠাম দেহের অধিকারী। তাদের দেহ মধ্যমাকার। মুখমণ্ডল সাধারণত গোলাকার এবং নাক চ্যাপ্টা হয়ে থাকে। চুল অকুঞ্চিত। এদের ভাষার নাম খাসিয়া বা খাসি। ভারতের মেঘালয় ও আসাম রাজ্য মিলিয়ে এরা খাসিয়া ভাষায় কথা বলে। খাসিয়া ভাষার সাথে মিয়ানমারের মোঁয়ে, পলং ভাষার এবং উপমহাদেশের তালাং, খেড়, সুক, আনাম, খামেন, চেচায়েম,লেমেত, ওয়া প্রভৃতি আদিবাসীর ভাষার মিল আছে। এই ভাষার কোনো নিজস্ব বর্ণমালা নেই। তবে ১৮১২ খ্রিষ্টাব্দে কৃষ্ণচন্দ্র পাল নামক একজন ধর্মযাজক সর্বপ্রথম বাংলা বর্ণমালায় ও খাসিয়া ভাষায় বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্ট অনুবাদ করেন। ১৮৩৮ খ্রিষ্টাব্দের পরে ওয়েলস মিশনারি দলের টমাস জোনস রোমান হরফে খাসিয়া ভাষা লেখার প্রচলন করেন। বর্তমানে খাসিয়া ভাষা রোমান হরফেই লেখা হয়। খাসিয়া ভাষার উপভাষাও রয়েছে বেশ কয়েকটি। তবে কেউ কেউ ইংরেজি বা বাংলায় কথা বলতে পারে।
সুদূর অতীতে খাসিয়ারা ভারতের আসাম উপত্যকায় পাহাড় টিলার পাদদেশের গুহায় বসবাস করত। প্রায় ছয়-সাত শ’ বছর আগে আসামের ভয়াল বন্যার স্রোতে খাসিয়ারা ভাসতে ভাসতে সিলেট চলে আসে। বানের পানিতে সভ্যতা-কৃষ্টির ভাষাগ্রন্থ, ধর্মগ্রন্থ সব কিছু হারিয়ে যায়। জৈন্তা রাজার অধীনে টিলার ওপর তারা পুঞ্জি স্থাপন করে। বৃহত্তর সিলেটের সদর, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলার অরণ্যঘেরা পাহাড়ি টিলায় বিপ্তিভাবে খাসিয়া আদিবাসীরা বসবাস করে। বিভিন্ন উত্থান-পতনের মধ্য দিয়েও খাসিয়ারা তাদের অতীত সামাজিক বোধকে এখনো ধরে রেখেছে। খাসিয়াদের কোনো নিকট প্রতিবেশী নেই। গারোদের মতো খাসিয়ারা মূলত মাতৃতান্ত্রিক সম্প্র্রদায়। এ কারণে খাসিয়া সমাজব্যবস্থায় মেয়েদের বিশেষ সম্মান ও আলাদা মর্যাদা রয়েছে। খাসিয়াদের মধ্যে প্রবাদ রয়েছে, ‘লংজেইদ না কিন থেই’; অর্থাৎ নারীদের হাতে মানবজাতির উৎপত্তি। এদের পরিবারের সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করেন নারীরা। নারীরা কনেযাত্রী নিয়ে বিয়ে করে বর নিয়ে আসেন বাড়িতে। আর নারীরা নিজেদের বাড়িতেই বাবা-মায়ের সাথে স্বামী-সন্তানসহ বসবাস করে থাকেন। মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় পরিচালিত খাসিয়াদের কোনো পুরুষ সম্পত্তির মালিক হন না। স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পদের মালিক হন নারীরা। স্ত্রীর বাড়িতে পুরুষেরা কাটিয়ে দেন জীবনের বাকি দিনগুলো। এদের পরিবারে নারীদের ভূমিকাই মুখ্য। পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ মেয়ের ধনসম্পদে বেশি প্রাধান্য থাকে। এদের বংশ পরিচয় দেয়া হয় মায়ের বংশানুক্রমে। খাসিয়া মেয়েরা দুই খণ্ড কাপড় পরিধান করে। এক খণ্ড ঊর্ধ্বাঙ্গে আরেক খণ্ড নাভির নিচে। শিশুদের পিঠে বেঁধে সাধারণত চলাফেরা করে। তারা অলঙ্কার পছন্দ করে। খাসিয়া মেয়েরা বাজারহাটে কেনাবেচা করে ও অসময়ে ভ্রমণ পছন্দ করে। উপজাতি খাসিয়া সম্প্রদায়ের আদি পেশা পান চাষ। গহিন অরণ্যে পতিত বনভূমি লিজ এনে পান চাষের উপযোগী করে বড় বড় গাছে পান চাষ করে। খাসিয়ারা পান চাষ করেই জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। তারা পান চাষের উপযোগী এলাকায় টিলার ওপর ঘর বেঁধে সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করে। প্রতিটি খাসিয়া পরিবার পান চাষের ওপর নির্ভরশীল। খাসিয়াদের উৎপাদিত পান ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য, পাকিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি হয়। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর খাসিয়া রাজতন্ত্রের অবসান হলেও আজো অতীত সমাজব্যবস্থাতেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছে তারা। তাদের সমাজের কর্তাব্যক্তিকে বলা হয় মন্ত্রী। রাজার আমলে নিয়োজিত বংশপরম্পরায় মন্ত্রীরা প্রতিটি পুঞ্জির শাসক, বিচারক ও রক। এক খণ্ড পাহাড়ি ভূমিতে পান চাষ ও বসবাসের স্থানকেই পুঞ্জি বলা হয়। একটি পুঞ্জিতে কমপক্ষে ৫০ থেকে ২০০ খাসিয়া পরিবার বাস করে। পুঞ্জির সব বিচার বৈঠক থেকে বিয়ের আচার-অনুষ্ঠানসহ প্রশাসনের সাথে সব ধরনের যোগাযোগ করেন মন্ত্রী। মন্ত্রীর সব খরচ খাসিয়ারা ‘কর’ হিসেবে প্রদান করে থাকে। খাসিয়াদের বড় অংশ সিলেটের উত্তরে মেঘালয়ের শিলং বসবাস করে। বৃহত্তর সিলেটে ৭২টি পুঞ্জি আছে। প্রতিটি পুঞ্জিতে গড়ে ৪০টি পরিবার বাস করে। খাসিয়া আদিবাসীরা ছয়টি গোত্রে বিভক্ত। গোত্রগুলো হলো লেংদু, সিংতে, লিংগাম, পনার, ভুই ও বার। ছয়টি গোত্রের মানুষ একই পুঞ্জিতে মন্ত্রীর অধীনে বাস করে। খাসিয়াদের নিজ গোত্রে বিয়ে নিষিদ্ধ। অন্য গোত্রের সাথে বিয়ে দিতে হয়। ছেলেমেয়েরা বড় হলে নিজেরাই স্বাধীনভাবে কিংবা পারিবারিক পছন্দে মন্ত্রীর অনুমোদনে এক পুঞ্জির মেয়ের সাথে অন্য পুঞ্জির ছেলের বিয়ে হয়ে থাকে। পাহাড়-টিলার পুঞ্জিতে বসবাসকারী খাসিয়ারা বেশ সুস্থ সবল। বৃদ্ধ বয়সে তারা সমতল থেকে ওপরের টিলায় ওঠানামা করতে পারে। শিশুরা জাপানি পুতুলের মতো ফুটফুটে। খাসিয়াদের কোনো রোগ হলে নিজেদের চিকিৎসা নিজেরাই করে এবং তারা বিশেষ করে জাদুমন্ত্রে বিশ্বাসী। খাসিয়াদের নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। নৃত্য-সঙ্গীত এদের খুবই প্রিয়। নানা ধরনের নাচগানে সবাই একত্র হয়। বিশেষত বড়দিনে আনন্দ উৎসব করে। নিজেদের গৎবাঁধা বনবাসী জীবন সংগ্রামের ফাঁকে কিছু কিছু সময় তাদের জন্য বিশেষ উৎসবের উপল নিয়ে আসে। এমনি একটি উৎসব ‘কা সেং কুটস্নেম’ (KA SENG KUTSNEM) খাসিয়া সম্প্রদায়ের নিজস্ব বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ উৎসব। নিজেদের ঐতিহ্যময় কৃষ্টি আর সংস্কৃতি চর্চায় হাসি-আনন্দে পুরনো দিনগুলোকে বিদায় দিয়ে এ উৎসবে নতুনকে আহ্বান করে নিলো নৃতাত্ত্বিক এই জনগোষ্ঠী। খাসিয়ারা এক সময় প্রকৃতি-পূজারী ছিল। এখন খ্রিষ্টান মিশনারিদের মাধ্যমে এদের প্রায় বেশির ভাগই খ্রিষ্টান। তবে এর পাশাপাশি এরা বিভিন্ন দেবদেবীর পূজা করে। তাদের বিশ্বাস, ‘ফব্লাই নাথউ’ই পৃথিবী সৃষ্টিকারী আদি দেবতা। এক সময় খাসিয়ারা টিলায় টিলায় ছন-বাঁশের ছাউনির মাটির কাঁচাঘরে বাস করত। সেকাল এখন খাসিয়াদের বিস্ময় স্মৃতি। খাসিয়ারা পান চাষে প্রায় সবাই এখন স্বাবলম্বী,
স্বনির্ভর। তাদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটায় ছেলেমেয়েরা এখন মিশনারি স্কুলে লেখাপড়া শিখছে।
খাসিয়ারা জেনারেটরের বিদ্যুৎ ব্যবহার করে ঘরকে আলোকিত করছে, ফ্রিজ, টিভি চালাচ্ছে। হাঁটি হাঁটি পা পা করে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে কিভাবে তারা ইট, বালু, সিমেন্ট, চুন লোহার রড ও টিন টিলার ওপরে তুলে এনে আধুনিক সৌন্দর্য জীবনযাপনের উপযোগী পাকা ও সেমিপাকা বাড়ি তৈরি করেছে; যা একবার দেখলে ভাবিয়ে তোলে।
লেখকঃ হারুন আহামেদ,সাংবাদিক, গোয়াইনঘাট।