পাবনার ঈশ্বরদী বর্তমানে বাংলাদেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা। এই ঈশ্বরদী উপজেলার মধ্যে অনেক পুরনো এবং বর্তমানের একাধিক স্থাপনা রয়েছে। প্রতি বছরই দেশ বিদেশ থেকে ভ্রমন পিপাসু মানুষ ঈশ্বরদীতে আসেন। তাই অনেকের মধ্যেই একটি প্রশ্ন কাজ করে ঈশ্বরদী নাম এর উদ্ভব কিভাবে কার মাধ্যম দিয়ে আসলো। তাহলে এখন আসা যাক কিভাবে ঈস্বরদী নামের উদ্ভব হলো…
ঈশ্বরদী নামের আদি জনপদটির নামকরণ কবে, কখন ও ঠিক কীভাবে হয়েছিল তার সঠিক ইতিহাস জানা যায় না। তবে এর নামকরণের সঙ্গে তত্কালীন বঙ্গদেশের বারোভূঁইয়াদের অন্যতম ঈশা খাঁর নাম জড়িয়ে আছে। তিনি একসময় তত্কালীন বঙ্গদেশের এক বিস্তীর্ণ এলাকা নিজের অধিকারভুক্ত করেছিলেন। অন্যমতে, সুবা বাংলার মোগল শাসক সুবাদার ইসলাম খাঁর আমলে ঈশা খান নামে একজন প্রাদেশিক শাসনকর্তা ছিলেন। ফলে সেই সময় ঈশ্বরদী এলাকাও উক্ত ঈশা খাঁর অধিকারভুক্ত ছিল। আবার অনেকে মনে করেন, মোগল সম্রাট আকবরের কাছ থেকে ২২ পরগনার জমিদারি লাভ করার পর পাবনা-ঈশ্বরদী হয়ে মুর্শিদাবাদ পর্যন্ত বিস্তৃত নবাবি আমলের রাস্তাটির নিরাপত্তাসহ এতদঞ্চলের শাসন কর্তৃত্ব সুরক্ষার জন্য সম্ভবত সেকালে স্বল্পকালের জন্য হলেও ঈশ্বরদীতে বারোভূঁইয়ার অন্যতম ঈশা খাঁর কোনো অশ্বারোহী বাহিনীর অবস্থান ছিল। এসব সংগত কারণেই এ এলাকার রাজস্ব আদায়ের জন্য সে সময় বারোভূঁইয়া খ্যাত ঈশা খাঁর কোনো ‘ডীহিদার’১ হয়তো ঈশ্বরদীতে নিযুক্ত ছিলেন। সে কারণে স্থানটি ‘ঈশা খাঁর ডিহি’ নামে পরিচিত হয়। লোকমুখে তা হয় ‘ঈ-শা-র-ডী’। পরে রূপান্তরের মাধ্যমে তা ‘ঈশ্বরদী’ নামে পরিচিতি পায়।
সাবেক ব্রিটিশ ও পাকিস্তান, এমনকি বাংলাদেশ আমলে গোটা বিশ শতকজুড়ে এর ইংরেজি বানান ছিল Ishurdi, যা প্রথমে Isha-Khar-Dehi, পরে তা সংক্ষেপিত হয়ে Ishur সঙ্গে Dehi সংযুক্ত হয়ে প্রথমে Ishurdehi এবং পরে তা আরো সংক্ষেপিত হয়ে Ishurdi বানানে রূপান্তরিত হয় বলেই ধারণা করা যায়। অন্যদিকে গুগলে প্রদর্শিত উইকিপিডিয়া অনুযায়ী ঈশ্বরদীর ইংরেজি বানান Ish-shordi গণ্য করে এর অর্থ ঈশ্বরের স্থান (God’s Place) বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
কেউ কেউ বলেন, প্রাচীনকালের গণ্ডগ্রাম ঈশ্বরদীতে একসময় ‘ঈশ্বরী দেবী’ নামে একজন খ্যাতিমান নারী অথবা ঈশ্বরচন্দ্র নামে কোনো একজন খ্যাতিমান ব্যক্তি ছিলেন। তাদের কারো নামেই স্থানটির নামকরণ হয় ‘ঈশ্বরদী’। তবে এ ধারণার কোনো ইতিহাসভিত্তিক বা যৌক্তিক বিশ্বাসযোগ্যতা না থাকায় তা তাদের ব্যক্তিগত অনুমান বলেই মনে হয়। কেউ কেউ অন্যমত প্রকাশ করে বলেন, বাংলার বারোভূঁইয়াদের অন্যতম ঈশা খাঁ কোনো একসময় পদ্মার পাশ দিয়ে সৈন্যসামন্ত নিয়ে যাতায়াত করার কারণে স্থানটির নাম হয় ‘ঈশাদী’। পরবর্তী সময়ে ঈশা খাঁর ‘ঈশাদী’ থেকেই জনপদটির নাম হয় ‘ঈশ্বরদী’। কিন্তু এ মতের সমর্থনেও কোনো জোরালো যুক্তি নেই। কেননা ইতিহাস সমর্থিত মতে বারোভূঁইয়াদের অন্যতম ঈশা খাঁর রাজত্ব ও বিচরণ ক্ষেত্র ছিল সোনারগাঁ (বর্তমান নারায়ণগঞ্জ জেলায়), হযরতনগর ও জঙ্গলবাড়ী (বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলায়) এলাকায়। তাছাড়া বাংলা অভিধান অনুযায়ী ‘ঈশাদী বা ঈসাদি’ শব্দের অর্থ সাক্ষী। সুতরাং অর্থগত দিক থেকে ‘ঈশাদী’র সঙ্গে ঈশা খাঁর কোনো সম্পর্ক নেই। তবে বাংলা অভিধানে ‘ঈশ’ নামে যে শব্দ দেখা যায়, তার আরেকটি বানানরূপ ‘ঈষ’। ঈশ যেমন ঈশ্বর, দেবতা, রাজা, অধিপতি প্রভৃতি অর্থে ব্যবহূত হয়, তেমনি ‘ঈশ্’ বা ‘ঈষ’ শব্দটির অর্থ লাঙলের (কাঠনির্মিত) দণ্ড বা লাঙলের খাত। সুতরাং ঈশ্বরদী নামের আদি জনপদটিতে প্রাচীনকালে ব্যাপকভাবে কাঠ দিয়ে লাঙলের দণ্ড, তথা ‘ঈশ্’ (বা ঈষ) তৈরি হতো কিনা বা সে কারণে স্থানটি বিখ্যাত হয়ে কালে কালে ‘ঈশ্বরদী’ নামে পরিচিত হয়ে উঠেছে কিনা, তাও গবেষণার বিষয়।