কবি সুফিয়া কামাল বলেছেন- সবুজ পাতার খামের ভিতর হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে, কোন পাথারের ওপার থেকে আনল ডেকে হেমন্তকে৷ “আসি আসি করে শীত বুঝি আর আসতে খুব দেরি নেই। চলছে হেমন্তকাল। হেমন্ত শেষ হওয়ার আগেই চলে এসেছে শীতের পরশ। কুয়াশার বুক চিরে ভোরের সূর্যোদয়, কিংবা সন্ধ্যার শীতল হাওয়া। এ যেন কার্তিকেই শীতের আগমনী বার্তা। ভোর আর সন্ধ্যার শীতল হাওয়া যেন বলছে শীত আর বেশি দূরে নেই।
হেমন্তের হাল্কা শীতের আবহাওয়াতে কুষ্টিয়া সহ আশ-পাশের জেলা ও গ্রাম গঞ্জে চলছে খেজুর গাছ থেকে খেজুরের রস সংগ্রহের কাজ৷ সকালের দূর্বাঘাস ও পত্রপল্লবে এসেছে শিশিরের ছোঁয়া৷ রাতের শেষ ভাগে শিশিরের টাপুর-টুপুর মন মাতানো শব্দে পুলকিত করেছে প্রকৃতিকে৷ এ যেন হেমন্তর আগমন বার্তা৷ তাই শুরু হয়েছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের প্রতীক খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের কাজ৷ খেজুর গাছের সাথে সংশ্লিষ্ট গাছিরা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে৷ জানাযায় ৯০-৯৫’র দশকে কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনার দক্ষিণাঞ্চলের প্রত্যন্ত অঞ্চল জুড়ে যতদূর চোখ যেত তা ছিল সবুজের মহা সমারোহ৷ সোনালী ফসলে ভরে থাকত সারা মাঠ৷ ক্ষেতের আইল দিয়ে দেখা মিলত হাজার হাজার খেজুর গাছের সারি৷ কিন্তু কয়েক বছরের ব্যবধানে সবকিছুই যেন অতীত৷ বর্তমানে বলা চলে অপরিকল্পিত নগরায়নের প্রতিযোগিতায় ইট, ভাটা ও শিল্প কল-কারখানায় বিরামহীন গতিতে গিলে খাচ্ছে কালের স্বাক্ষী খেজুর গাছগুলোকে৷ শীতের সকালে সোনালী রোদে বসে মিষ্টি খেজুরের রসের স্বাদ ও যেন তাই আজ ভুলতে বসেছে চিরচেনা কুষ্টিয়াসহ পাশের জেলার মানুষেরা৷ তবুও যেখানে যে গাছগুলো এখনও নিরবে দাঁড়িয়ে আছে সেগুলোকে নিয়েই যেন গাছিদের শুরু হয়েছে অন্য রকম ব্যস্ততা৷ সব মিলিয়ে শরৎ শেষে হেমন্তের প্রকৃতিই জাগান দিচ্ছে শীত এসেছে৷
শীত আসলেই ব্যস্ত হয়ে পড়েন গাছিরা। বিকেল হলেই গাছে হাঁড়ি বসাতেন আবার সকাল হলে রস সংগ্রহ করে বাড়ি নিয়ে আসতেন। দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত চলতো গুড় আর পাটালি তৈরির কাজ। খেজুরের গুড় আর পাটালির মৌ মৌ গন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়াতো। কেউ কেউ রস বিক্রি করতেন আবার কেউ স্বজনদের বাড়িতেও পাঠাতেন। কালের বিবর্তনে এসব এখন ইতিহাসের পাতায় জড়ো হচ্ছে। হারিয়ে যেতে বসেছে গাছ। প্রতিবছর শীতে তৈরি হচ্ছে খেজুরের গুড়। রস ও গুড় কিনতে বাগানে ভিড় করেন বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ। শীতের প্রতিটি সকালেই এই বাগান গুলোতে লেগে থাকে রসমেলা উৎসব। প্রকৃতিতে বইছে শীতের আগমনী বার্তা। সকালের শিশির ভেজা ঘাস আর হালকা কুয়াশায় প্রস্তুত হচ্ছে প্রকৃতি।
এবছরও সেই আয়োজনের প্রস্তুতি নিতে দেখা যাচ্ছে গ্রামগুলোতে। রস সংগ্রহের জন্য এখন গাছকে বিশেষ পদ্ধতিতে প্রস্তুত করা হচ্ছে। সপ্তাখানেকের মধ্যেই পুরো দমে রস সংগ্রহ শুরু হবে বলে জানিয়েছেন গাছিরা৷ প্রায় ৪-৫ বছর ধরে গ্রামে বাণিজ্যিকভাবে খেজুরের রস থেকে গুড় উৎপাদন শুরু হয়েছে। গ্রামটিতে গড়ে ওঠা বাগানগুলোতে এখন সেই এলাকার অর্থনৈতিক উন্নায়নের কাণ্ডারি বলে জানান এলাকাবাসী।
গাছ একবার ছাঁটলে তিন-চার দিন রস সংগ্রহ করা যায় এবং পরবর্তীতে তিন দিন শুকাতে হয়। এভাবে কাটলে গাছের রস সুমিষ্ট হয়। রস সাধারণত নভেম্বর থেকে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত সংগ্রহ করা যায়। রস সংগ্রহের পর হাড়ি পরিষ্কার করে রোদে শুকাতে হয় অথবা আগুনে ছেকে নিতে হয়। এতে সংগৃহীত রসে গাঁজন বন্ধ হয়। ঝুঁকি নিয়েই কোমরে রশি (দড়ি) বেঁধে গাছে ঝুলে রস সংগ্রহের কাজ করেন গাছিরা।
প্রতিদিন বিকেলে ছোট-বড় মাটির হাঁড়ি গাছে বাঁধা হয়, আর সকালে রস সংগ্রহ করা হয়। কেউ কেউ কাঁচা রস এলাকার বিভিন্ন স্থানে ও হাটে-বাজারে খাওয়ার জন্য বিক্রি করেন। আবার কেউ কেউ সকালেই এই রস জ্বালিয়ে গুড় তৈরি করেন।
উল্লেখ্য, এক গাছির থেকে শোনা যাই, বর্তমানে যে হারে খেজুর গাছ হারিয়ে যেতে বসেছে, তাতে এক সময় হয়তো আমাদের দেশে খেজুর গাছ থাকবে না। তাই গাছের সাথে সাথে গাছিরাও যেন তাদের পেশা পরিবর্তন করে চলে গেছে অন্য পেশায়। কোন কোন এলাকায় যারা এখনও বাপ-দাদার পেশা আঁকড়ে পড়ে আছে গাছির পেশায় তাদেরও যেন যায় যায় অবস্থা। কেমন যাচ্ছে তাদের দিন-কাল এমন প্রশ্ন করতেই যেন বড় একটা দীর্ঘশ্বাস, তারপর ছল-ছল চোখে বলেন গ্রামে এখন খেজুর গাছ নেই তাই তাদের আর ভালো থাকা। কুষ্টিয়ার ঢাকাগ্রাম (বাইপাস সড়ক), মিনাপাড়া, ফুলবাড়ি, বটতৈল (ক্যানাল পাড়া) পোড়াদহ, মিরপুর, ঝিনাইদহ, যশোর, আলমডাঙ্গা, খুলনাসহ সেদিকের মাঠে এখনও কিছু কিছু গাছ রয়েছে। শীতের আগমনি বার্তাতে খেজুর গাছ নাকি গাছিদের আহব্বান করে রস সংগ্রহ করার জন্য।
সবাই আম, কাঁঠাল আর লিচু নিয়েই ব্যস্ত। সব গাছেরই প্রয়োজন আছে। তাই নতুন করে খেজুরের বাগান বা খেজুরের গাছ রোপণে সবাইকে একযোগে কাজ করে এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে হবে।