মহাসড়কের পাশে রঙ্গিন ছাতা ও কাঠের ব্রেঞ্চ নিয়ে একটু আড়ালেই দলবদ্ধভাবে বসে আছে কয়েকজন যুবক। হাতে রয়েছে কয়েক রকমের রশিদ ও কলম। ব্যাটারি ও ইঞ্জিনচালিত মালবাহী ট্রাকসহ ছোট-বড় যেকোন যানবাহন দেখলেই দৌড়ে এসে হাত মেরে জোরপূর্বক মহাসড়কেই থামিয়ে দিচ্ছে চলন্ত যানবাহনকে। তারপর একটি রশিদ দিয়ে চালক ও তার সহকারীর কাছ থেকে টোলের নামে আদায় করা হচ্ছে টাকা। সেই রশিদে নাম লিখা রয়েছে ইজারাদারের। টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ বা দেরি হলেই চালকের সাথে মারমুখী আচরন ও দীর্ঘসময় গাড়ি আটকে রাখছেন তারা। এভাবেই প্রকাশ্যে পৌরসভার টোল আদায়ের নামে চাঁদাবাজীর দৃশ্যের দেখা মিলেছে পাবনার ঈশ্বরদী পৌর শহরের বেশ কিছু এলাকায়।
জানা গেছে, ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে এক লক্ষ টাকায় পৌরসভা থেকে টোল আদায়ের নামমাত্র ইজারা পান মোঃ আবুল কাশেম। সেই ইজারাদারের নামেই উপজেলার বকুলের মোড়, চাঁদআলীর মোড়, রেলগেট, ভেলুপাড়া মোড়সহ পাঁচটি স্থানে প্রায় ১৫ জন দীর্ঘদিন যাবত এ চাঁদা আদায়ের কাজ করে আসছেন। প্রতিটি মালবাহী ট্রাক, পিকআপ, কাভার্ডভ্যান, নছিমন, বাস, মিনিবাস থেকে ৫০ টাকা, অবৈধ ইঞ্জিনচালিত ভটভটি থেকে ২০ টাকা ও পন্যবাহী ব্যাটারিচালিত ভ্যান থেকে ১০ টাকা করে প্রতিদিন চার শতাধিক যানবাহন থেকে ৩২ হাজার টাকা চাঁদা উত্তোলন করা হয়। সেই হিসাবে মাসে ৯ লক্ষ টাকা ও বছরে এক কোটি টাকার বেশি চাঁদাবাজি হয়। তবে রাত হলে নির্ধারিত মুল্যের থেকে বেশি চাঁদা এবং অনেক সময় রশিদ ছাড়াই চাঁদা দিতে হয় বলে অভিযোগ অধিকাংশ চালকের।
সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভা এলাকার সড়ক-মহাসড়কে যানবাহন থামিয়ে ইজারার নামে টোল আদায় বন্ধে মাননীয় হাইকোর্টে দায়েরকৃত রিট পিটিশন নং-৪৬৪০ এর প্রেক্ষিতে ২০২২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পৌর-১ এর উপসচিব মেয়রদের চিঠি দেন। চিঠিতে উল্লেখ্য যে টার্মিনাল ব্যাতিরেকে কোন সড়ক বা মহাসড়কে যানবাহন থামিয়ে টোল উত্তোলন না করার জন্য সকল সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার মেয়রের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিজ্ঞপ্তি জারি করার জন্য সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ হতে নির্দেশনা প্রদান করা হয়। নির্দেশনা অমান্য করে ইজারার নামে সড়ক-মহাসড়ক থেকে টোল আদায় সম্পূর্ণ অবৈধ ও ফৌজদারি অপরাধের আওতাভুক্ত। তবে সেই নির্দেশনার তোয়াক্কা না করেই স্থানীয় আঃলীগ ও সহযোগী সংগঠনের পদে থাকা ওয়ার্ড পর্যায়ের বেশ কয়েক নেতার নেতৃত্বে সড়কে যানবাহন থামিয়ে পৌরসভার নামে চাঁদা আদায় হচ্ছে। তবে এ ব্যাপারে প্রশাসনের ভুমিকাও বেশ নিরব থাকতেই দেখা গেছে।
ট্রাকচালকরা জানান, ঈশ্বরদীতে ট্রাকের নির্দিষ্ট কোন টার্মিনাল না থাকার কারনে পৌরসভার নাম করে ইজারাদারের লোকজন সড়ক-মহাসড়কে যানবাহন থামিয়ে চাঁদা আদায় করছে। ঈশ্বরদীতে আসার আগে পাবনা শহরে দুই শত টাকা দিয়েছি। সারা বছরই তারা এভাবে চাঁদা আদায় করে। চাঁদার টাকা দিতে দেরি হলে বা অস্বীকৃতি জানালে ব্যাপক নাজেহালে পড়তে হয়। এছাড়াও রাত ১০ টার পর গাড়ি নিয়ে ঢুকলেই তারা রশিদ ছাড়াই বাড়তি টাকা চাই।
পাবনা থেকে ব্যাটারিচালিত ভ্যানে ফার্ণিচারের মাল নিয়ে ঈশ্বরদী আসছিলেন মোঃ আমিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমার পৌরসভার লাইসেন্স করা আছে তারপরও আমার থেকে জোর করে পাঁচ টাকার পরিবর্তে দশ টাকা নিয়েছে। লাইসেন্স করা থাকলে কোথাও চাঁদা দেওয়ার নিয়ম নাই। চাঁদার টাকা না দিলে ইজারাদারের লোকজন আমাদের সঙ্গে অনেক খারাপ ব্যাবহার করে।
বিভিন্ন পয়েন্টেআদায়কারীদের সাথে কথা হলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বলেন, আমরা পৌরসভার নির্ধারিত ইজারাদারদের নিয়োগকৃত শ্রমিক হিসেবে এ টাকা তুলছি। টাকা আদায় করে ইজারাদারের হাতে দিয়ে আসি। আমরা পারিশ্রমিকের ভিত্তিতে এ কাজ করি। তবে এ টাকা কোথায় যায়, কি কাজে ব্যবহার হয় তার কিছুই জানিনা।
রশিদে উল্লেখিত পৌরসভার ইজারাদার আবুল কাশেম বলেন, পৌরসভার অনুমতিক্রমে ইজারার মাধ্যমে আমরা এ টাকা আদায় করছি। প্রতি বছরই পৌরসভার নয়টি ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের দায়িত্বে থাকা সভাপতি ও সাধারন সম্পাদকদের নিয়ে পৌরসভাকে নির্দিষ্ট পরিমান অর্থ দিয়ে টোল আদায়ের ইজারা নিতে হয়।
পৌরসভার ২ নং ওয়ার্ড আঃলীগের সাধারন সম্পাদক রেজাউল করিম নান্টু ও ৮ নং ওয়ার্ড আঃলীগের সভাপতি ওসমান আলী বলেন, এক বছর পর পর পৌরসভা থেকে ইজারা নিয়ে এ টোল আদায় করা হয়। পৌরসভার নয়টি ওয়ার্ডের মোট ১৮ জন নেতার সমন্বয়ে ইজারা নিয়ে এ টোল আদায় করা হয়। তবে এ টোল আদায়ের বৈধতা কতটুকু রয়েছে তা জানতে চাইলে ওয়ার্ড আঃলীগের সভাপতি-সম্পাদকগন ও ইজারাদার আবুল কাশেম পৌরসভার মেয়রের সাথে যোগাযোগ করতে বলেন।
ঈশ্বরদী পৌরসভার মেয়র ইসাহক আলী মালিথা বলেন, গত ১৩ বছর যাবত পৌরসভার উন্নয়নের জন্য সড়ক মহাসড়ক থেকে টোল আদায় করা হচ্ছে। তবে এটি ইজারার মাধ্যমে আদায় করা হচ্ছে। ইজারার কাগজপত্র সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি পৌর নির্বাহী কর্মকর্তার সাথে কথা বলতে বলেন।
পৌর নির্বাহী কর্মকর্তা জহুরুল ইসলামের কাছে ইজারা সম্পর্কিত তথ্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, পৌরসভার আওতাধীন যে ওয়ার্ডগুলো রয়েছে সে সকল ওয়ার্ডে আঃলীগের দায়িত্বে থাকা নেতারা সামান্য কিছু টাকা দিয়ে পৌরসভার অনুমতি নিয়ে এ টোল আদায় করছেন। আদায়কৃত টোলের টাকা তারাই ভাগাভাগি করে নেন। তবে ইজারার সঠিক কোন তথ্য বা কাগজ তারা দেখাতে পারেননি। এ বিষয়ে প্রতিবেদককে তারা সংবাদ প্রকাশ না করার অনুরোধও করেন তিনি।
ঈশ্বরদী সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বিপ্লব কুমার গোস্বামী বলেন, সড়কে যানবাহন থামিয়ে চাঁদা আদায়ের ব্যাপার টা আমার জানা নেই। তবে সড়কে যেসব যানবাহন চলাচল অবৈধ সেসব যানবাহন থেকে টোলের নামে চাঁদা আদায় কখনও বৈধ হতে পারেনা। এ বিষয়ে আমার ট্রাফিক বিভাগ ও পৌর মেয়রের সাথে কথা বলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।