সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ০৬:২৬ পূর্বাহ্ন
শিরোনামঃ
শিরোনামঃ
ঈশ্বরদীর ২ ইট ভাটায় অভিযান// দেড় লাখ টাকা জরিমানা আদায় ঈশ্বরদীতে ঘরবাড়ি ভাংচুরের প্রতিবাদে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত  ঈশ্বরদীতে অবৈধ বালু মহল চক্রের ১২ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব ঈশ্বরদীতে প্রশাসনকে ম্যানেজ করে মেম্বারের কৃষি জমির মাটি বিক্রয়  ঈশ্বরদীতে ২ টি গাঁজা’র গাছ সহ একজনকে আটক করেছে পুলিশ  ঈশ্বরদী উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ৩ চেয়ারম্যান প্রার্থীসহ মোট ১৪ জনের মনোনয়ন দাখিল  ঈশ্বরদী তে এমপির নির্দেশে “পৌর ছাত্রলীগের তীব্র দাবদাহে পিপাসা মেটানোর জন্য শরবত বিতরণ” আমার পক্ষে ভোট চাইলে কারো মাথা নিচু হবে না-আবুল কালাম আজাদ মিন্টু ঈশ্বরদীতে পৃথক ঘটনায় দুই যুবকের মরদেহ উদ্ধার আত্মহত্যার ঘটনাকে হত্যা বলে প্রচারের অভিযোগ 

রবীন্দ্রজীবনে লালন প্রভাব

জাগ্রত সকাল ডেস্ক / ৪৫৬ বার পঠিত
আপডেট : রবিবার, ৮ আগস্ট, ২০২১, ১০:০২ অপরাহ্ণ

ভাস্কর সরকার :
সর্বকাল ধরে একদল মানুষ শাস্ত্রাচারের গন্ডির বাইরে থেকে মানব মুক্তি ও ঈশ্বর লাভের পথ খুঁজেছেন। সবকিছুকে দূরে সরিয়ে ধর্মকে হৃদয়ে ধারণ করে সহজ সত্যের আলোকে চিনতে চেষ্টা করেছেন। তেমনই একদলের মহামতি সাধক পুরুষ লালন সাঁই। ‘যা আছে ভান্ডে, তা আছে ব্রহ্মান্ডে’ অর্থাৎ মানব দেহই একটা ছোট ব্রহ্মান্ড। শাস্ত্রের যে ঈশ্বর ধর্মকর্মের ব্যবহারে লাগেন,তিনি সনাতনপন্থী ধার্মিক লোকের ঈশ্বর, তাঁকে নিয়ে আনুষ্ঠানিক শোক চলে; তাঁর জন্যে অনেক সূরা-আয়াত, মন্ত্রতন্ত্র; আর যে ঈশ্বরকে নিজের দেহভান্ডের মধ্যে ভক্ত সত্য করে উপলব্ধি করেছেন কিংবা দেখেছেন, যিনি অহেতুক আনন্দের ঈশ্বর, তাঁকে নিয়ে শুধু গানই গাওয়া যায়। লালন সাঁই তাঁর গানের মাধ্যমে আধ্যাত্মবাদী ও দেহতাত্ত্বিক সাধনার পথ প্রদর্শন করেছেন। কখনও অচীন পাখি, কিংবা অধর সাঁই অথবা মনের মানুষ রূপে এক বৃহত্তর শক্তিকে খুঁজে বেড়িয়েছেন। তাঁর গানের নিগূঢ় অর্থ সহজে বোধগম্য নয়। আজ আধুনিক বিজ্ঞানের বিশ্বে তাঁকে এবং তাঁর সাধনা ও সৃষ্টি নিয়ে চলছে গবেষণা।
অন্যদিকে বাংলা সাহিত্যের আর এক কীর্তিমান প্রাণপুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যার পদচারণা সাহিত্যের প্রতিটি শাখায়। একমাত্র মহাকাব্য ছাড়া সাহিত্যের যে কোন স্থানে তাঁর অবাধ বিচরণ। বিশ্বকবি উপাধি ও নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তিই তাঁর প্রতিভার মুখ্য পরিচয় বহন করে। তথাপি রবীন্দ্রনাথ লালনকে এড়িয়ে যেতে পারেননি। কথায় আছে রতনে রতন চেনে, তাই ঠিকই চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছিল। জমিদারীর কাজে রবীন্দ্রনাথ যখন কুষ্টিয়া জেলার শিলাইদহে বসবাসরত তখন লালনের শিষ্যসহ বহু বাউল সাধকের সাথে তাঁর সখ্যতা হয়েছিল। তবে সরাসরি লালনের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছে কিনা এ নিয়ে মতানৈক্য আছে। সাক্ষাৎ হোক বা না হোক সেটার বিতর্কে আমরা যাবনা। তবে তিনি যে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে লালনের গান ও দর্শনে আসক্ত হয়েছিলেন এটা তার রচনার দিকে অবলোকন করলেই অনুধাবন করা যায়। ড. আবুল আহসান চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন,
বাউল গান, বিশেষ করে লালনের গান, রবীন্দ্রমননে যেমন তার সঙ্গীতেও তেমনি স্পষ্ট ছাপ ফেলেছে, প্রেরণা হয়েছে অনেক কবিতার। রবীন্দ্রনাথের বাউলাঙ্গের গানে লালনগীতির কথা ও সুরের প্রভাব এবং সাদৃশ্য দুর্লক্ষ্য নয়। লালনের অন্তিম মুহূর্তে রচিত ‘পার করো হে দয়াল চাঁদ আমারে’ এ গানটির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষপ্রান্তে রচিত ‘সমুখে শান্তিপারাবার ভাষাও তরণী হে কর্ণধার’ -এর আত্মিক মিল আবিস্কার করা যায়। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন শক্তিমান, সচেতন, অসামান্য এক শিল্পীপুরুষ। তাই তিনি লালনের বাণী ও সুরকে ভেঙ্গে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে নতুন উপকরণে সজ্জিত করেছেন, যা একান্তই রবীন্দ্রবাউলের রচনা।
গোরা উপন্যাসে প্রথম তিনি লালনের ‘খাঁচার ভিতর অচীন পাখি কেমনে আসে যায়, তারে ধরতে পারলে মন বেড়ি দিতাম পাখির পায়’ গানটি ব্যবহার করেন। সম্ভবত এই গানটিই রবীন্দ্র মানসে প্রথম প্রভাব বিস্তার করে। সুকুমার সেন তাই যথাযথ মন্তব্য করেন যে, ‘বাউল গানের এই ….পদটি কবিচিত্তে দীক্ষাবীজ বপন করিয়াছিল’। আমাদের দেহ খাঁচার মধ্যে আত্মা কিভাবে যাওয়া আসা করে এই কথা রবীন্দ্র মনে প্রশ্নের অবতারণা ঘটায়। একজন অশিক্ষিত বাউল সেটা উপলব্ধি করেছেন এবং সুন্দর সাবলীল শব্দ প্রয়োগে যথার্থ বাক্য গঠনের মাধ্যমে গানের আকারে সুর বেঁধেছেন। একজন শিক্ষিতের কাছে এসব গানের ভাবার্থ বোঝা কষ্টকরই বটে। তাই রবীন্দ্রনাথ ব্যক্ত করেছেন যে, আমাদের চারপাশে খড়কুটোর মত অনেক কিছুই পড়ে আছে যা আমরা খুঁজে পাইনা। বাউল গানের সাথে সম্পৃক্ততার কথা বলতে গিয়ে হারামণিতে তিনি বলেন,
…বাউল পদাবলীর প্রতি আমার অনুরাগ আমি অনেক লেখায় প্রকাশ করেছি। …আমার অনেক গানেই আমি বাউলের সুর গ্রহণ করেছি। এবং অনেক গানে অন্য রাগরাগিনীর সঙ্গে আমরা জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বাউল সুরের মিল ঘটেছে। এর থেকে বোঝা যাবে, বাউলের সুর ও বাণী কোন্ একসময়ে আমার মনের মধ্যে সহজ হয়ে মিশে গেছে।
শুধু তাই নয়; পত্রপুট কাব্যের পনেরো সংখ্যক কবিতায় তিনি দৃঢ়ভাবে বাউলদের সাথে নিজের সাজাত্য ঘোষণা করেছেন। বাউলদের প্রতি তাঁর মমত্ববোধ এবং উচ্ছ্বাসের কথা তিনি এভাবে ব্যক্ত করেন,
কতদিন দেখেছি ওদের সাধককে
একলা প্রভাতের রৌদ্রে সেই পদ্মানদীর ধারে
যে নদীর নেই কোন দ্বিধা।
পাকাদেউলের পুরাতন ভিত ভেঙ্গে ফেলতে।
দেখেছি একতারা হাতে চলেছে গানের ধারা বেয়ে
মনের মানুষকে সন্ধান করবার
গভীর নির্জন পথে।”
[পত্রপুট]
এমনিভাবে রবীন্দ্রনাথ লালন প্রভাবে আপ্লুত হয়ে বিভিন্ন ভাষণ এবং প্রথম ১৩২২ সনে প্রবাসী পত্রিকার হরামণি বিভাগে সংগৃহীত বাউল গান প্রকাশের মাধ্যমে লালনকে বিশ্ববাসীর নিকট পরিচয় করিয়ে দেন।
রবীন্দ্রজীবন ও চেতনায় লালনের পরোক্ষ প্রভাবের কথা রবীন্দ্রনাথ নিজে অস্বীকার করতে পারেনি। লালনের মনের মানুষ এবং রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতা যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। বাউলের সাধনার গুপ্ত ক্রিয়াকর্মকে তিনি গ্রহণ করেননি। তিনি গ্রহণ করেছিলেন বাউল দর্শনের নানা ভাবদ্যোতক কথামালা এবং দিক নির্দেশনা। এ প্রসঙ্গে ড. আনোয়ারুল করীম এভাবে ব্যক্ত করেন যে,
রবীন্দ্রনাথের সমগ্র সাহিত্যে ও সংগীতকর্মে বাউলের প্রভাব অত্যন্ত গভীর এবং আবেগ আশ্রিত। বাউল ধর্ম এবং দর্শনকে তিনি তাঁর জীবনদর্শন বলে গণ্য করেছেন। অবশ্য তাঁর এই বিশ্বাস একজন সাহিত্যিকের মন ও ভাবনা প্রসূত; বাউলদের গুপ্ত সাধনা কিংবা রীতিনীতির সঙ্গে তা সম্পৃক্ত নয়। বলা যেতে পারে বাউলদের বহিরঙ্গে যে জীবনবোধ উদ্ভাসিত হয়েছিল, তাকেই রবীন্দ্রনাথ গ্রহণ করেছিল। তাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনা, মানবিক মূল্যবোধ, জাতিভেদ প্রথাকে অস্বীকার করে সর্বধর্মকে সমন্বিত করবার যে প্রচেষ্টা এবং সর্বোপরি তাদের গান রবীন্দ্রনাথকে আশৈশব প্রাণিত করেছিল।
বাউল সাধনা গুহ্য সাধনা। যার প্রকাশ গানের মাধ্যমে হয়ে থাকে। তাই বাউলরা বলে থাকেন ‘গানই জ্ঞান’। রবীন্দ্রনাথ অনেক সময় এসব গানের ভাব ও কথার অর্থ খুঁজতে গিয়ে বাউলদের নিয়েই সমস্ত দিবস অতিবাহিত করেছেন। এমনকি নিজের গানের মধ্যে বাউল আঙ্গিকের ভাব ও সুরের প্রকাশ করেছেন। এ কথা সত্য যে তিনি সুরের চাইতে ভাবকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। তবে বাউল সুরকে তিনি অস্বীকার করেননি। বলা যেতে পারে তিনি  সুরকে ঢেলে-মেজে এক নতুন সুরে রূপ দিয়েছেন। এই সুর তাঁর নিজস্ব। মূলত বাউল গানের সুর উদাসীসুর। বাউলদের এই উদাসী এবং আত্মনিমগ্নের ভাব রবীন্দ্রনাথকে প্রভাবিত করেছিল। হৃদয়ের ব্যথা-আকুতি প্রকাশ করতে গিয়ে যে সুর আপনি জেগেছে তাইই রবীন্দ্র বাউলের সুর। কোন এক আপন জনের অভাবে হৃদয়ে যে গভীর বেদনা অনুভব করা যায়, রবীন্দ্রনাথ সে কথাই ব্যক্ত করেছেন স্বীয় গানে। বাউল প্রভাবের যথার্থতা এখানে। বাউল ও রবীন্দ্রবাউলের মনের মানুষ যেন একই সত্তা। লালন যেমন মনের মানুষকে দেখার জন্য দেহঘরের চাবি হাতরিয়ে বেড়িয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ ঠিক একই কাজ করেছেন। তাইতো তাঁদের এতো আত্মিক মিল। লালন একটি গানে বলেছেন,
“আমার ঘরের চাবি পরের হাতে
কেমনে খুলিয়া সে ধন দেখব চক্ষেতে৷”
একই ভাবার্থপূর্ণ কথা রবীন্দ্রনাথের গানেও প্রকাশ পেয়েছে,
“ভেঙ্গে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে
ও বন্ধু আমার!
না পেয়ে তোমার দেখা, একা একা দিন যে আমার কাটে না রে।”
আমি কে? আমার আমি আমার মাঝেই বিরাজমান। কিন্তু সে অধরা। তাই নিজেকে চিনতে পারলেই অচেনাকে চেনা যাবে। একই কথা হাদীসেও বলা আছে, ‘মান আরাফা নাফসাহু, ফাকাদ আরাফা রাব্বাহু’ অর্থাৎ – যে নিজেকে চিনেছে সে আল্লাহকে চিনেছে। আবার খ্রিষ্টপূর্বাব্দে সক্রেটিস একই কথা বলেন, ‘নো দ্যাই সেলফ’ অর্থাৎ- নিজেকে চেন। তাই নিজেকে চেনার পরম আকুতি রবীন্দ্র-লালনের গানের অসংখ্য পদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। আমি এত কাছে অবস্থান করেও মনেহয় লক্ষ যোজন ফাঁকে তাঁর অবস্থান। সেই আমাকে চেনার বা দেখার আর্তি লালনের গানে ফুটে উঠেছে,
“আমার ঘরখানায় কে বিরাজ করে।
আমি জনম-ভর একদিন দেখলাম না রে \
নড়ে চড়ে ঈশান কোণে
দেখতে পাইনে এই নয়নে
হাতের কাছে যার ভাবের হাটবাজার
আমি ধরতে গেলে হাতে পাইনে তারে৷”
আমি কে না চিনলে সাধন সিদ্ধি হয়না। আমি হলো পরমাত্মার খন্ডাংশ অর্থাৎ জীবাত্মা। বাউল এই খন্ডাংশকে বলে অটল মানুষ, সহজ মানুষ, রসের মানুষ, ভাবের মানুষ, অলখ সাঁই, অচিন পাখী, মনুরা ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথ যাকে জীবনদেবতা বা মানসসুন্দরী বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি উপলব্ধি করেছেন আত্মা ও পরমাত্মা অভিন্ন। সাকার দেহের মধ্যে নিরাকার আনন্দস্বরূপ আত্মাকে স্বরূপে উপলব্ধি করাই হলো মানব জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য। কেননা জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলনেই মহাসুখ অনুভব করা যায়। সুফি ও বাউল যাকে বলে ফানা বা সিদ্ধিলাভ। তাই সেই পরমাত্মার সন্ধান করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,
“আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে
দেখতে আমি পাইনি
তোমায় দেখতে আমি পাইনি।
বাহির-পানে চোখ মেলেছি,
মম হৃদয়-পানে চাইনি৷”
সেই অধরা যদি আমার মধ্যেই বর্তমান তাহলে যেখানে সেখানে কেন এত খোঁজাখুজি কিংবা ডাকাডাকি? আল্ কোরআনে বলা হচ্ছে, আমি তোমাদের প্রাণরগ অপেক্ষাও নিকটতর। বলা হচ্ছে, তোমরা যা ব্যক্ত কর কিংবা গুপ্ত রাখ সব আমি অবগত। তাহলে কেন মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, প্যাগোডায় অনুসন্ধান। তাই লালন বলেছেন,
“কাছের মানুষ ডাকছো কেন শোর করে
আছিস তুই যেখানে সেও সেখানে খুঁজে বেড়াও কারে৷”
রবীন্দ্রনাথ তাঁর মানসসুন্দরীকে অন্তরগৃহের অন্তর্যামী রূপে কল্পণা করেছেন। ‘আমার অন্তরগৃহে, যে গুপ্ত আলয়ে/ অন্তর্যামী জেগে আছে সুখদুঃখ লয়ে’।
আবার গানের সুরে একই কথা বলেছেন এভাবে,
“আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে
তাই হেরি তায় সকল খানে৷…
ও তোরা আয়রে ধেয়ে দেখরে চেয়ে আমার বুকে
ওরে দেখরে আমার দু’নয়নে৷”
রবীন্দ্রনাথ তাঁর নাটককেও লালন দর্শন থেকে প্রভাবমুক্ত করতে পারেননি। তিনি রাজা নাটক বাউল তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে রচনা করেছিলেন এবং এই নাটকে ‘কে কথা কয়রে দেখা দেয়না আমায়’ লালনের প্রাতিস্বিক গানের ভাব সত্যকে রূপায়িত করেছেন। রাজা নাটকের ‘রাজা’ চরিত্রটি সর্বদাই নেপথ্যে থেকেছেন এবং এই রাজা হলেন বিশ্বাত্মা আর সুদর্শনা হলো মানবাত্মার প্রতীক। অর্থাৎ জীবাত্মা ও পরমাত্মার পরিপূর্ণ মিলনের কথাই রূপ পেয়েছে রাজা নাটকে। এই নাটকে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বাউলের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। এছাড়া অচলায়তন এবং ডাকঘর নাটকের মধ্যে বাউলের আধ্যাত্মিক ভাবধারার প্রতিচ্ছবি পরিস্ফুটন হয়েছে। রাজা-অচলায়তন-ডাকঘর এই তিনটি নাটক অরূপ সাধনার সাংকেতিক নাটক হিসাবে পাঠক এবং দর্শকের কাছে উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে। এ বিষয়ে ড. ক্ষুদিরাম দাস বলেন,
“অচলায়তনে সমাজ-নিহিত প্রাচীন কুসংস্কারের ধ্বংসকারী ও নিপীড়িত মানবাত্মার মুক্তিসাধকরূপে মানুষের মধ্য দিয়েই ক্রিয়াশীল সংগ্রামী অরূপের আবির্ভাব কল্পনা করা হয়েছে। রাজা নাটকে এই অরূপের প্রায় সম্পূর্ণ একটি রূপ কবি উদ্ঘাটন করতে চেয়েছেন। রাজায় প্রতিপন্ন করা হয়েছে যে তিনি কেবল মনোহর ও ইদ্রিয়গ্রাহ্য সুন্দর নন, তিনি ভয়ংকর-সুন্দর এবং এই দুইরূপে যিনি তাঁকে জানেন তাঁরই অন্তরের গোপনকক্ষে তিনি আস্বাদন-যোগ্য, যে কক্ষে পার্থিব বুদ্ধি প্রবেশ করতে পারেনা, বুদ্ধি যতই তীক্ষ, হোক না কেন। ডাকঘরে রাজা-অচলায়তনেরই ধারা অনুবর্তন ক’রে সদা-কিশোর কবির ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিক আকুতির স্বরূপ ও রাজার আগমনের প্রকার বর্ণিত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ লালনকে ভালবেসেছিলেন, লালনের গান হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন এবং লালনের প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন এ কথা আজ অস্বীকার করা যায় না। রবীন্দ্রনাথ স্বীয় জীবনস্মৃতিতে (১৩১৯) লালনের গান সম্পর্কে অভিমত প্রকাশ করেন যে, ‘দেখিলাম, বাউলের গানও ঠিক একই কথা বলিতেছে। মাঝে মাঝে বন্ধ খাঁচার মধ্যে আসিয়া অচিন পাখি বন্ধনহীন অচেনার কথা বলিয়া যায়; মন তাহাকে চিরন্তন করিয়া ধরিয়া রাখিতে চায়, কিন্তু পারেনা। এই অচিন পাখির যাওয়া-আসার খবর গানের সুর ছাড়া আর কে দিতে পারে।’ শুধু তাই নয়; ভালবাসার প্রমাণ স্বরূপ লালনের একমাত্র গানের খাতা বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রসদনে এখনও অরক্ষিত রয়েছে। যদিও তাঁদের বাহ্যিক সাধনার পথ আলাদা ছিল কিন্তু আভ্যন্তরীন লক্ষ্য একই ছিল। তারা দু’জনেই মানুষের কথা বলেছেন, মানুষের সেবা করেছেন এবং মানুষের মাঝেই মনের মানুষের সন্ধান করেছেন। তাই রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি এবং লালন বাউল সম্রাট। পরিশেষে সাঁইজীর কথায় বলতে হয়,
‘সহজ মানুষ ভজে দেখনারে মন দিব্য জ্ঞানে
পাবিরে অমূল্য নিধি বর্তমানে।’
আজ তাঁরা দুই জনের কেউ নাই এই ধরিত্রীতে, আছে শুধু তাঁদের অমর সৃষ্টি৷ আমি সম্বলহীন নিঃস্ব দেয়ার মতো কিছু নাই, আজ ২২ শ্রাবণ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণ দিবসে বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা৷
সহায়ক গ্রন্থাবলি :
১। আমার দেশ, শুক্রবার, ১৩ই মে ২০০৫৷
২। সুকুমার সেন, বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস (৩য় খন্ড), ১৩৬৮, কলিকাতা৷
৩। মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন, হারামণি (১ম খন্ড), বৈশাখ ১৩৩৭, কলকাতা, ভূমিকা অংশ
৪। ড. আনোয়ারুল করীম, রবীন্দ্রনাথ ও বাংলার বাউল, বইমেলা-২০০১,নওরোজ কিতাবিস্তান, ঢাকা৷
৫। ড. ক্ষুদিরাম দাস, রবীন্দ্র-প্রতিভার পরিচয়, সেপ্টেম্বর-১৯৯৬, মলি­ক ব্রাদার্স, কোলকাতা৷
৬। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনস্মৃতি, জৈষ্ঠ-মাঘ ১৩৬৮, বিশ্বভারতী, কলিকাতা৷
লেখক
ভাস্কর সরকার
গবেষক ও প্রাবন্ধিক
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
ইমেইল: bhaskar07@live.com


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরও খবর

ফেসবুকে আমরা

এক ক্লিকে বিভাগের খবর
Bengali Bengali English English Russian Russian
error: Content is protected !!
Bengali Bengali English English Russian Russian
error: Content is protected !!